দোঁহা

কুলেখাড়ার খোঁজে

 



মহুয়া রায়


লোডশেডিং। হারিকেনের টিমটিমে আলোতে ঠাকুমাকে ঘিরে বসেছে নাতি নাতনীরা। ঠাকুমা গল্প বলো। গল্প-ঠাকুমার চোখ যেন কোন সুদূরে পাড়ি দিয়েছে। তাঁর গা ঘেঁষে বসা নাতি নাতনীদের থেকে দূরে বহুদূরে কোথাও । দাদাভাই, দিদিভাইরা, জীবনের ঘটনা কখনো কখনো গল্পের থিকাও অবিশ্বাস্য হয় তাই না! তাইলে শোনো সেই গল্প। শুরু করলেন ঠাকুমা তাঁর নিজস্ব ভঙ্গীতে-আমরা তহন দ্যাশে।তোমাগো বাবা তহন ইস্কুলের ছাত্র। দ্যাশ স্বাধীন হইছে শুইন্যা কি আনন্দ, কি আনন্দ! আমার আর  কাকীমার সবুজ, কমলা রঙের শাড়ি আর বাবার সাদা ধুতি দিয়া একখান বিরাট বড়ো জাতীয় পতাকা বানাইলো। একখান লম্বা বাঁশের মাথায় টানাইয়া দীঘির পাড়ে দাঁড়াইয়া উড়াইতে লাগল। আর মুখে বন্দেমাতরম ধ্বনি। তহন তোমাগো ছোটো দাদু আইয়া কইলেন করো কি মনু, কাগো পতাকা উড়াও? "দ্যাশ ভাগ হইয়া গেছে, আমরা এখন আর ইন্ডিয়াতে নাই, আমাগো দ্যাশের নাম এখন পাকিস্তান"। পিঠে যেন চাবুকের বাড়ি পড়ল! সেই যে স্কুলের মাঠে সবাই মিলে 'বন্দেমাতরম' বলা, 'ধনধান্য পুষ্পে ভরা' গান গাওয়া, তার কি কোনো মূল্যই রইলো না? পাকিস্তান কোথায়? কতদূরে? কেমন সে দেশ? আমাদের মতোই কথা বলে, খাবার খায়! হাজারো প্রশ্ন সেই কিশোরের মনে।

ঠাকুমার মুখে এখন কিশোরটির জবানবন্দী। বাড়িতে চাপা উত্তেজনা।অন্দরমহলে কাকীমা জ্যেঠিমাদের ফিসফিসানি। কানে ভেসে আসে দু'একটা শব্দ-ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, কলকাতা। বারবাড়িতে শোনে বাড়ি জমি কেনাবেচার কথা। আশঙ্কায় দোলে তার কিশোরমন। চারপাশের মানুষের ব্যবহারও যেন পাল্টে যাচ্ছে। একসঙ্গে খেলাধূলা করা মুখগুলো খেলার মাঠে আর আগের সুরে বাজছে না। আনোয়ার তো সেদিন বলেই ফেললো, "এইডা এ্যাহন খালি আমাগোই দ্যাশ বুঝলা, খালি মোছলমানেগো। তগো দ্যাশ ঐ যে ওইদিক, ঐ ইন্ডিয়াতে", বলে কোনো একদিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে দেখালো। সেটা কোনদিক কে জানে! আনোয়ার নিজেও কি জানে! খেলার মাঠ থেকে গলায় দলা পাকানো এক বুক কান্না নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়। পথে জয়নাল চাচার সঙ্গে দেখা। একরাশ আশা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "চাচা, আনোয়ার কয় এইডা আর আমাগো দ্যাশ না। হেইডা কি ঠিক কথা! আমরা তো এহন স্বাধীন, ইংরেজরা তো আর রাজা নাই, তাইলে?" দু'চোখ ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসে। জয়নাল চাচা মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন, "হ্যাঁ রে বাপধন।" তারপর তিনিও যেন চোখের জল গোপন করে হনহন করে এগিয়ে গেলেন।                            

তারপর শুরু হল অন্য এক অধ্যায়। চারিদিক থমথমে। রাতের বেলা চুপিসাড়ে গোছানো সংসার গুটিয়ে পাড়ি দেওয়া অন্য কোনো দেশে, অন্য কোনো পরিচয়ে। পিছনে পড়ে রইলো গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু আর অসংখ্য টুকরো টুকরো ভালো-মন্দ লাগা। মা, কাকীদের চোখের জল বাধ মানছে না। বাবা, কাকারা পুরুষ মানুষ তাই তাঁদের কাঁদতে নেই কিন্তু, কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাস। "ও বড়ো বৌ, মেজো বৌ, রাস্তায় পোলাপানগো খাওনের লাইগ্যা কিছু শুকনা মুড়ি, চিড়া, গুড় বাইন্ধা লইও"- দরজার বাইরে থেকে জ্যাঠামশায়ের গলা। ছোটো কাকা পেশায় ডাক্তার তায় দরকারে অদরকারে সকলের পাশে দাঁড়ান। সেই কারণেই হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে অনেকেই এই পরিবারের শুভানুধ্যায়ী কিন্তু, এখন তো পরিস্থিতিটাই অন্যরকম। ইচ্ছে থাকলেও অনেকে পাশে দাঁড়াতে পারছেন না।

পাশের বাড়ির রেজিনা চাচী এসে একটা পুঁটুলি মায়ের হাতে দিয়ে বললেন, "মনুর মা, এর মইধ্যে কতগুলা নাইরকেলের নাড়ু আছে, পোলাপাইনগো রাস্তায় দিও"। ডুকরে ওঠা কান্নাকে আঁচল চেপে সামাল দিয়ে মা কে জড়িয়ে ধরলেন। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলো ঘুমে আধবোঁজা চোখ খুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। রাতের অন্ধকারে বাড়ির পিছনের খালে বাঁধা নৌকোতে উঠতেই নৌকো চলল প্রায় নিঃশব্দে। কিছুটা গেলেই নৌকো পড়বে বড় নদীতে। ব্যস আর ভয় নেই। ছোটো ছোটো ভাইবোনেরা ঘুমিয়ে কাদা। ঘুম নেই সেই কিশোরের চোখে। তার বেড়ে ওঠার মাঠ, ঘাট, নদী, আকাশ সব আজ রক্তাক্ত। তারাও কি ভাগ হয়ে গেছে ধর্মের ভিত্তিতে! নিজের জন্মস্থান ছেড়ে যাবার যন্ত্রণা আর অজানা দেশের আতঙ্ক দুই মিলেমিশে তার কোমল মনটিকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। বাবা, জ্যেঠামশাই, কাকা ভীত, চিন্তিত তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কি হবে! কোথায় যাবে! এর মাঝেই কখন চোখ লেগে এসেছিল টেরও পায়নি। ঘুম ভাঙ্গলো বাবার ডাকে- "মনু, উইঠ্যা পড়ো, আমরা আইয়া পড়ছি"! আইয়া পড়ছি! কোথায় আইলাম? কিশোরটি একছুটে নৌকোর পাটাতনে। "আমরা তো ইন্ডিয়া যাইতেছি মনু, কাইলই তো কইলাম"। দমে যাওয়া মন নিয়ে কিশোরটি নৌকো থেকে নামল। প্রবেশ করল নতুন একটি ভূখন্ডে। কেমন যেন রুক্ষ শুষ্ক। কোথায় সেই সবুজ ভূখন্ড রূপোর ফিতের মতো নদী। চারিদিকে লোক আর লোক, থিকথিক করছে। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের কান্না, চিৎকার। রাস্তার পাশেই বসেছে মানুষের রান্নাঘর। অন্তঃপুরিকারা আজ রাস্তায় বসিয়েছেন তাঁদের পাকশালা। সবথেকে ছোট ভাইটির বয়স তখন দুই থেকে আড়াই বছর। রাস্তার পাশে কারোর উনুনে স্যাঁকা হচ্ছিল আটার রুটি, ফুলে ফুটবলের মতো দেখতে হয়েছে। ছোটো ভাইটি বায়না ধরলো "ঐগুলা খামু!" সে কি কান্না! রুটি তৈরি করা মহিলাটি একটি রুটি এনে দিলেন ভাইয়ের হাতে। বাবার জোগাড় করে আনা একটি গাড়িতে এতগুলো লোক ঠাসাঠাসি করে চললাম  কলকাতার উদ্দেশ্যে। ধীরে ধীরে গাড়িটা বড়রাস্তা ছেড়ে গলির মধ্যে একটি দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। জানা গেল আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি এটা। সবার চালচলন যেন একদিনের মধ্যেই কিরকম পাল্টে গেছে। একটা জড়তা, আড়ষ্টতা একটা দীনতা যেন বড়দের গ্রাস করে ফেলেছে। ছোটরা অবশ্য ঐবাড়ির ছোটদের সঙ্গে বেশ মিলেমিশে গেল। বাবা, জ্যেঠামশাই রোজই বেরোচ্ছেন চাকরির খোঁজে। কাকা ডাক্তার হবার ফলে গলির মুখেই একটা চেম্বার খুলে বসলেন। পথের যাত্রা তো শেষ হলো , শুরু হলো জীবনের যাত্রা। মা কাকিমারা মাথায় তুলে নিলেন আশ্রয়দাতা পরিবারের বেশির ভাগ কাজ। বাচ্চাদের ভর্তি করে দেওয়া হলো কাছেরই একটা স্কুলে। উঁচু দেওয়াল ঘেরা স্কুলে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। চোখ ফেটে জল আসে। আকাশের ডানা মেলা পাখী যেন ডানা ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়েছে। আরো বড়ো সমস্যা দেখা দিল ভাষা নিয়ে! তাদের বাংলাভাষা কোথায় যেন আলাদা এদের বলা বাংলাভাষার সঙ্গে। কিছু দুষ্টু ছেলে খেপায় 'বাঙাল, ভাতের কাঙাল'... কেউ বা বলে ঐ যে 'বাঙাল' আসছে। কেন বলে বাঙাল কারা কিছুই ঢোকেনা ছেলেটির মাথায়। শুধু এটুকু বুঝতে পারে তারা এখানে অনাকাঙ্খিত। এভাবেই সময়ের পলি জমতে জমতে একে একে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডী পেরোনো সেই কিশোর আজ পূর্ণ বয়স্ক। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ভরা সংসার তবুও কোথাও যেন একটা অতৃপ্তি, একটা মায়া, একটা তীব্র মনখারাপের অনুভূতি!

তাঁর সন্তানেরাও শোনে দেশভাগের কাহিনী বাবার মুখে ঠাকুমার মুখে। কিন্তু, ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারেনা। আজকের দিনে যখন জীবিকার তাগিদে লোকে এমনিতেই বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে তখন অন্য  দেশে বাসা বাঁধায় এত কষ্ট কেন!? কিন্তু, তার মনও একদিন পাল্টালো। সেজো পিসী এসেছেন বেড়াতে। তিনি এখন মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা। দাদার বাড়িতে বেড়াতে এসে গল্পগাছা চলছে। নদীর মতোই শাখাপ্রশাখা মেলছে কথার ঝুলি। একসময় উঠে এল কুলেখাড়া শাকের কথা যা নাকি রক্তাল্পতার অসুখে একেবারে ধন্বন্তরি। বোন জিজ্ঞাসা করল দাদাকে, কুলেখাড়া কিরকম দেখতে? আরে, জানিস না! রান্না ঘরের পাশে বেড়ার  ধারে যে ছোটো ছোটো কাঁটাওয়ালা গাছগুলো ছিল-সেটাই! পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় আগে সেই কিশোরবয়সে ছেড়ে আসা বাড়ির কথা এমন অনায়াসে বলা যায়? বাবা পিসীর কথা শুনে হতবাক সেই মেয়েটির মনেও ভালবাসা জাগল সেই অদেখা দেশটির প্রতি বাবার ছেড়ে আসা বাড়িটির প্রতি।

বাবার মুখে শুনেছে তাঁদের সম্পন্ন গৃহস্থালীর কথা। সমৃদ্ধ শিক্ষিত পরিবারের সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে বাবার জ্যেঠামশাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁদেরই দীঘির পাড়ে দশম শ্রেণী পর্যন্ত একটি বিদ্যালয়। সেই মান যশ ছেড়ে এসে তাঁর ভুগতেন মনোকষ্টে। কত পরিবার তো আর কোনোদিন মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারলো না। মনে পড়লো রেললাইনের দু'পাশে সারি সারি মাথা গোঁজার ঠাঁই। তাঁদের সঙ্গে শ্বাস প্রশ্বাসের মতোই জুড়ে গেছে 'রিফিউজি' শব্দটি। যেসব বাড়িতে দু'বেলা অগুনতি পাত পড়তো, পাশের বাড়ির কমবয়েসী ছেলেটা উঠোনে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়তো, "বৌঠান কি পাক করতেছেন? রান্নার সুঘ্রাণ যে এই অবধি টাইন্যা আনলো।" অথবা খিড়কির দরজা থেকে চুপিসাড়ে আসা সেই নীলিমা, যে রান্নাঘরের জানলা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতো, ও জ্যাঠাইমা, আইজ দুপুরে আমি তোমাগো বাসায় খামু। সেইরকম অজস্র জ্যাঠাইমা, মাসী কাকীদের আজ রেললাইনের পাশের ঝুপড়িতে বাস। তাঁদের দাপুটে কর্তারা আজ কেউ রিক্সা চালায়। মহিলারা কেউ কাজের মাসী কেউবা ঠোঙা বানিয়ে দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছেন। জীবনের ধর্ম নাকি 'চরৈবেতি'। এর নামই কি চলা!

তৃতীয় প্রজন্মের সেই মেয়েটি প্রতিজ্ঞা করলো, যাদের কাহিনী কেবল লেখা আছে কলমের কালিতে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, সেখানে একদিন সে যাবেই! যাবে, বাবার আদরের ভালবাসায় সিঞ্চিত ছোটোবেলার দেশে, সেই কুলেখাড়ার খোঁজে।

1 মন্তব্যসমূহ

  1. Very sentimental and sensitive presentation. Whole world should be one country. Any partition and division destroy the humanity. লেখককে ধন্যবাদ। এই সুন্দর উপস্থাপনার জন্য। What a sensetive presentation,full of reality and beyond

    উত্তরমুছুন
নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন