দোঁহা

'মেনোপজ'-এক অধ্যায়

 



অদিতি সেনগুপ্ত

শীতের রাত, নরম তুলতুলে রেজাইয়ের বেষ্টনীতে নিশ্চিত ঘুম। হঠাৎই একটা উষ্ণ স্রোত আনখশীর! নিশ্চিত ঘুমের দফারফা। এক বোতল জল এক ঢোকে গলাধঃকরণ করেও শুষ্কতা দূর হয় কই! ৪৫ এর জন্মদিন গেল মাসদুয়েক আগেই। চল্লিশের পর একটা করে জন্মদিন যোগ হতে হতে এগিয়ে চলেছে এক অমোঘ ভবিতব‍্যের দিকে প্রতিদিন। 'পেরিমেনোপজ‍্যাল' স্টেজের সূচনাবার্তা জানান দিতে শুরু করেছে শরীর। বাহ‍্যিকরূপে সময় ততটা থাবা বসাতে না পারলেও অন্দরমহলে শুরু হয়েছে ভাঙন। আর ব্রেনে রিনরিন করে ধরা পড়ছে একটাই সিগন্যাল, আজি মেনোপজ জাগ্রত দ্বারে। 

শোনা যায় বিধাতার তরবারি অতীব সূক্ষ্ণ। এই তরবারির আঘাত প্রথমবার প্রতিটি মেয়ের জীবনে যখন নেমে আসে তারপর থেকে ক‍্যালেন্ডারের পাতায় রবিবার ছাড়াও মাসের আরও কয়েকটা দিনের রঙ হয়ে যায় লাল। সমাজ চিহ্নিত করে, "আজ থেকে তুমি 'নারী'।" তারপর মাসের ওইকটা দিন এক অসহনীয় যন্ত্রণা আর অস্বস্তি নিয়ে হাসিমুখে সকল কর্ম করে যেতে হয়। কারণ নিত‍্যরোগ গুরুত্ব পায় না আর ঋতুস্রাবকে রোগ হিসেবে মেনেও নেওয়া হয় না। শুধু একটা নারী শরীর বোঝে প্রতিমাসের এই অনিষিক্ত ডিম্বাণু নিষ্ক্রমণের যন্ত্রণা আর হরমোনের বদলে মেজাজের ওঠাপড়া। 

তারপর দিন বদলায়, সময় এগিয়ে যায় নিজের গতিতে। নারী শরীরটি নানান বাঁকবদলের মধ‍্য দিয়ে অবশেষে পৌঁছে যায় এক অন‍্য বসন্তে। তখনই আবার আবির্ভূত হন বিধাতাঠাকুর তাঁর সেই সূক্ষ্ম তরবারি হাতে। আবার তার এক আঘাতে ক‍্যালেন্ডারে পাতায় তখন লালরঙ মানে শুধুই রবিবার। আবার সমাজ তাকে চিহ্নিত করে এক নতুন পরিচয়ে। ১১/১২ বছর বয়স থেকে শুরু হওয়া সেই যন্ত্রণাময় অধ‍্যায়ের অবসানে কিন্তু খুশি হতে পারে না নারীর শরীর-মন। অন্তর থেকে আর্তি ওঠে, "সুখের কথা বোলোনা আর বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি। দুঃখে আছি, আছি ভাল, দুঃখেই আমি ভাল থাকি।" আর ঠিক এই আর্তিটাকেই কাজে লাগিয়ে ষাটের দশক থেকে ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করল এক ব‍্যাবসা। বাজারে এলো 'হরমোন রিপ্লেসমেনট থেরাপি' বা HRT। বিজ্ঞান বলল, অক্ষয় হবে নারীর যৌবন। HRT হলো যাকে বলে যৌবনের অমৃত। আর্থিকভাবে সমাজের উচ্চস্তরে থাকা নারীদের জীবনে যেন নবজোয়াড় এলো। এক বন্ধু হঠাৎ একদিন ফোনে বলল, “আরে খবর শুনেছিস?” প্রচণ্ড উত্তেজিত তাই উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে চলল, “Did you hear about HRT? যাক বাবা, ইনার গার্মেন্টস খুলে শুতেই ভয় লাগত, খুললেই ডিমের পোচ! তারপর তো অন্যান্য জটিলতা আছেই। ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছিলাম রীতিমত। আমি বাবা করাচ্ছি HRT…” শুধু আমার বন্ধু নয় এই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল আপামর বিশ্বে। শরীরের বিশেষ অঙ্গগুলির দৃঢ়তা হারানোর ভয় আর থাকল না। বলিরেখার বলি হতে হবে না আর নির্দিষ্ট সময়ের বৃত্তে। আসুক বিধাতা, হানুক আঘাত তাঁর তরবারির আর তো ডরাই না তাঁকে সাথে আছে HRT। অলক্ষ‍্যে মুচকি হাসলেন বিধাতা। ঝাঁ চকচকে বিজ্ঞাপনের আলোর ঝলকানিতে ঢাকা পড়ে গেলো HRT এর এক ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। যে রোগের চূড়ান্ত ফলাফল আজও পরাজয়, সেই ক‍্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে গেলো বহুল মাত্রায়। আসলে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করলে তার ফলাফল তো এমনটাই হওয়ার কথা। একলাফে বেড়ে গেলো ক্যানসার আক্রান্ত নারীদের সংখ্যা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, ৯৫ শতাংশ মারণরোগের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও HRT –এর জনপ্রিয়তায় তেমন ভাঁটা পড়ল না, বাহ্যিক রূপের এমনই মোহ! আসলে সকল নারীর গোপন ঘরে বাস করে এক ক্লিওপেট্রা।

পোস্ট মেনোপজাল সিন্ড্রোম বা PMS আজকের যুগে বেশিরভাগ মানুষের কাছেই পরিচিত একটি টার্ম। এই PMS প্রতিটি নারীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। Menopause বা রজঃনিবৃত্তি বলতে সাধারাণতঃ পিরিওড বা মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধের পরবর্তী অবস্থাকে চিহ্নিত করে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, এক নারীর সাধারণত টানা ১২ মাস বা ততধিক সময় ধরে মাসিক রজঃচক্র না ঘটলে ধরে নেওয়া হয় যে তার রজঃনিবৃত্তি ঘটেছে। আর এই সময়ে একজন নারী যেসমস্ত সমস্যাগুলির সম্মুখীন হন সামগ্রিকভাবে তাকেই বলা হয় Post Menopausal Syndromes বা PMS। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে একজন নারীর রজঃনিবৃত্তি ঘটে। আর এই সময়টাতেই পি.এম.এস. দেখা দেয়। অবশ্য অনেকক্ষেত্রে অস্ত্রপ্রচারের কারণে অনেক কম বয়েসেই ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে রজঃনিবৃত্তি দশা শুরু হয়ে যায়। একে বলা হয় ক্লিনিকাল মেনোপজ। ক্লিনিকাল হোক বা স্বাভাবিক, রজঃনিবৃত্তির পর প্রত্যেক নারীই নানাভাবে প্রভাবিত হন। এসময় নারীদের স্তন শিথিল হয়ে যাওয়া, চুল পড়া, ওজন বৃদ্ধি, ত্বকের টানটান ভাব নষ্ট হয়ে যাওয়া, প্রস্রাবের অস্বাভাবিকতা, যৌন শীতলতার মত বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। এর প্রভাব শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনকেও বিষাদগ্রস্থ করে তোলে। এই সময়টাতে হৃদরোগ, ফাইব্রয়েডস এবং অস্টিওপোরোসিস (হাড়ের ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি) এর মত রোগের ঝুঁকিও অনেকাংশে বেড়ে যায়। যেহেতু এসময় Ovulation ঘটেনা, তাই নারীদেহের প্রোজেস্টেরন হরমোনের পরিমান প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে আসে। আর এর ফলে নারীরা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার মধ্যে পড়েন। ইস্ট্রোজেন হরমোন উৎপাদনও ৪০ থেকে ৬০ ভাগ কমে আসে। আর সকলেই জানে যে নারী দেহকে সুস্থ রাখতে এই ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরণ হরমোনের একে অপরের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই প্রয়োজন। এই দুটি হরমোনের ভারসাম্য বজায় থাকলে একজন নারী সতেজ, উৎফুল্ল এবং সর্বপোরী সুস্থ থাকে। রজঃনিবৃত্তির সময়ে নারীদেহ যেসব শারীরিক অসুস্থতার সম্মুখীন হয় তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রোজেস্টেরন হরমোনের ঘাটতির কারণে, ইস্ট্রোজেনের ঘাটতির কারণে নয়। পি.এম.এস-এর লক্ষণ হিসেবে রজঃনিবৃত্তির পরেও যোনিপথ হতে পাতলা, স্বচ্ছ তরলের নিঃসরণ ঘটতে পারে যা ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে আসার কারণে হতে পারে। এক্ষেত্রে তরলের সাথে ঈষৎ রক্তবর্ণ যুক্ত হতে পারে। চেহারায় রোমের পরিমান বৃদ্ধিও পি.এম.এস-এর একটি লক্ষণ যা ইস্ট্রোজেন এবং টেস্টোস্টেরন হরমোন ক্ষরণের তারতম্যের কারণে ঘটে। টেস্টোস্টেরন ছেলেদের হরমোন হলেও মেয়েদের শরীরেও সামান্য মাত্রায় নিঃসরিত হয় যা মুখমন্ডল, বগল, হাত-পা ও উরুসন্ধির রোম সৃষ্টির কারণ। এছাড়া মানসিক অস্থিরতা, উদ্বেগ, নিদ্রাহীনতা, মুডসুইং ইত্যাদি উপসর্গও এ সময় নারীদের মধ্যে দেখা দেয়। পি.এম.এস-এর সেরকম কোনও  চিকিৎসা না থাকলেও কিছু নিয়ম মেনে চললে এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। এসময় নারীদের যথেষ্ট পরিমান পুষ্টিকর খাবার, ব্যায়াম ও বিশ্রামের প্রয়োজন। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে এসময় বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। কম চর্বি, অধিক আঁশ যুক্ত খাবার এবং প্রচুর পরিমাণে তাজা ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে। কফি ও মশলাদার খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। কিছু প্রশান্তিদায়ক ব্যায়াম আছে যা উদ্বেগের মাত্রা কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। ধূমপানের অভ্যেস থাকলে তা অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে কেননা এটি অন্যান্য আরও স্বাস্থ্যঝুঁকি, যেমন- উচ্চ মাত্রায় কলেস্টরল, রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদরোগ এবং দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়াকে তরান্বিত করে।

পরিশেষে বলি, কঠিন হলেও “সত্যেরে লও সহজে…” জীবনে যা ঘটা অনিবার্য তাতো ঘটবেই। তবুও প্রতিদিন বাঁচতে হবে মনের আনন্দে। বলিরেখা পড়ুক ত্বকে, বিবর্ণ হয়ে যাক কেশ কিন্তু অন্তর থাক চিরহরিৎ।

1 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন