দোঁহা

গণতন্ত্রের উৎসব, উৎসবের গণতন্ত্র

 



সুমি দত্তগুপ্ত

গণতন্ত্র কাকে বলে, সে কি খায়, না মাথায় দেয়। গণতন্ত্র মানে কি শুধু আমার ভোট, আমার নিজস্ব অধিকার? না! ভোট তো আমার কন্ঠস্বর, যা আমাকে বোঝায়, আমার অধিকারের কথা, যা আমার পাওয়ার কথা, যে ন্যূনতম অধিকার আমার, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য শাসক আমাদের দিতে বাধ্য তার বিন্দুমাত্র বত্যয় ঘটলে সোচ্চার হওয়া।

লিংকনের সেই উক্তি  ভুললে চলবে কেন গনতন্ত্র হল জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার।

কিন্তু বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতবর্ষে ভোট এখন একটি উৎসব মাত্র। ১৮ বছর বয়স হলে আমরা সাবালকত্বের এই প্রমাণপত্র দাখিলের জন্য আকুলি বিকুলি করতে থাকি, কিন্তু আমরা জানিনা কি আমাদের মৌলিক অধিকার যা সরকারের কাছ থেকে আমাদের পাওয়ার কথা, কি ই বা আমাদের মৌলিক কর্তব্য যা আমাদের দেশের প্রতি পালন করা কর্তব্য।

ইভিএম মেশিনে ভোটাধিকার প্রয়োগ আমাদের কাছে বিশ্ব জয়ের সামিল। প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষণ আমাদের শিখিয়েছেন ইভিএম মেশিনের বোতাম টিপে পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন কতটা জরুরি।  কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধি জনগণের কাজে গাফিলতি করলে, দুর্নীতি, অসততার সাথে যুক্ত হলে তাকে গদিচ্যুত করা, তার অপশাসনের বিরুদ্ধে সরব হওয়াও তো গণতন্ত্রের শিক্ষা। তার প্রয়োগ কোথায়?

গণতন্ত্রের শুরু যেখান থেকে সেই ক্লিসথেনিসের 'এথেনিয়ান'-এ গণতন্ত্রের মূল কথা ছিল পুরুষদের বাক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা। মহিলারা ছিল এর থেকে অনেক দূরে। যদিও স্পার্টায় আমরা নারীদের সুযোগ সুবিধার স্বীকৃতির কথা জানতে পারি। এথেনসে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হত, গণ পরিষদ ছিল, তার কাছে নির্বাচিত সদস্যরা তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকতেন।

গণতন্ত্র কি প্রাচীন ভারতবর্ষে ছিল না? ঋক বৈদিক সমাজ গোষ্ঠী ভিত্তিক সমাজ হলেও সমাজের সব সদস্যের মতানুক্রমে গোষ্ঠিপতি নির্বাচিত হতেন, কিন্তু তিনি রাজা নন। তাকেও সভা ও সমিতি নামক দুটি প্রতিষ্ঠানের যুক্তি পরামর্শে কাজ করতে হোত আর সমাজের সমস্ত সদস্য সম্পদ ও জমির ওপর সবার সমানাধিকার ছিল। এটা কী গণতন্ত্র নয়?

গণতান্ত্রিকতারও রকমফের আমরা প্রাচীন ভারতে লক্ষ্য করি। বৌদ্ধযুগ কোনও কোনও ঐতিহাসিকের চোখে সামন্ততন্ত্রের যুগ বলে চিহ্নিত হলেও আমরা দেখেছি সেখানেও রাজা সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতিতে নির্বাচিত হতেন। তাই তিনি ছিলেন - 'মহাজনসম্মত'। তিনি ব্যক্তি ও সমষ্টির রক্ষাকর্তা।

'সংঘম শরণম গচ্ছামি ‘ আমাদের স্মরণ করায় সন্ন্যাস জীবনেও তোমার বুদ্ধত্ব বা জ্ঞানের প্রতি সম্মান জানিয়ে তোমাকে সংঘের বা বৌদ্ধ বিহারের প্রতি আনুগত্য দেখাতে হবে। এটাই সমষ্টি তন্ত্র, এরই আধুনিক রূপ হল গণতন্ত্র।

বাংলায় রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে যে মাৎস্যন্যায় দেখা দেয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে বিশৃঙ্খলার অবসানে জনগণ গোপালকে গনতান্ত্রিক উপায়ে রাজা নির্বাচিত করেন।

তবে আধুনিক গণতন্ত্রের শুরু জন লকের ধারণায় আর তাকে বাস্তবসম্মত রূপদান করেন আব্রাহাম লিংকন। ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিকতার সাধনা অনেক আগেই শুরু হলেও মাঝখানের সময়টা শুধু রাজতন্ত্রের শোষণ, অত্যাচার, কখনও উদারনীতিবাদ, মানবতাবাদের মিশেল আর তার ওপরে রয়েছে ঔপনিবেশিকতাবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন।

গণতন্ত্রের মুখ আবার দেখলাম ১৯৫০ সালে। সংসদীয় প্রতিনিধিত্ব মূলক গণতন্ত্রে। ১৯৫১-৫২ সালের নির্বাচনে নারী পুরুষ, ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে সব মানুষের হাতে এলো ক্ষমতা, প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষমতা ভোটদানের মাধ্যমে। শুরু হল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের ভোটদান যজ্ঞ ব্যালট পেপারের মাধ্যমে। ইভিএম মেশিনের সাহায্যে ১৯৯০ সালে ভোটদান ব্যবস্থাকে আরও জনমনোহারিণী, গ্রহনযোগ্য ও আস্থাশীল করে তুললেন তদানীন্তন নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষন। ভারতীয় গণতন্ত্র আরও সাবালক হল।

কিন্তু সেই সাবালকত্ব প্রাপ্তিকে পরিণত করতে পারলাম কই? সংবিধানকে মান্যতা না দিয়ে, যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে, রাজতন্ত্রের মহিমায় বংশতন্ত্রের কৌলীন্য প্রতিষ্ঠা করে, জনসাধারণের বাক স্বাধীনতা হরণ করে, রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘন করে, জরুরি অবস্থার অছিলায় মানবাধিকার এ অনভিপ্রেত অযাচিত হস্তক্ষেপ করে, তথ্যের অধিকার আইন লঙ্ঘন করে,দলত্যাগ বিরোধী আইনকে বৃদ্ধানগুষ্ঠ দেখিয়ে যত্র তত্র যে কোনো সময় শিবির বদল করে, জনসাধারণের উন্নয়ন তহবিলের যথেচ্ছ ব্যবহার করে৷ আইনসভায় বিরোধী দলের কন্ঠস্বর রুদ্ধ করে, জনসাধারণের প্রদেয় রাজস্ব হিসাব বহির্ভূত ভাবে ব্যবহার করে দলদাসদের তোষণ, পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি তে মানুষকে অভ্যস্ত করে তোলা, শিক্ষা,স্বাস্থ্য মানুষের ন্যূনতম চাহিদাগুলোর রন্ধ্রে,রন্ধ্রে রাজনীতি ঢুকিয়ে দেওয়া এই গণতন্ত্র, শুধু ভোটদানে সীমাবদ্ধ গণতন্ত্র তো আমরা চাইনি। কিন্তু,আমাদের সাধের NOTA অধিকারও আজ প্রশ্নাতীত নয়। সুপ্রীম কোর্ট নির্বাচন কমিশনের কাছে আর্জি জানিয়েছেন,যে নির্বাচন কেন্দ্রে NOTA সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে; সেখানে যেন আবার নির্বাচনের  ব্যবস্থা করা হয়। NOTA র  উদ্দেশ্য কি থাকলো আমার মত স্থূল মস্তিষ্কে তা বোধগম্যের অতীত থাকলো।

২০০৫ সালে যে তথ্যের অধিকার আইন চালু হল তার মূল লক্ষ্য তো ছিলদেশের জনগণকে ক্ষমতার কেন্দ্রে না।এটি ঠিকভাবে চালু করার জন্য, শাসক কে, রাজ্য ও আঞ্চলিক স্তরের নেতাদের অবশ্যই সরকারি কর্মকাণ্ড সঙ্গে জনগণকে যুক্ত করা এবং তাদের কাছে জবাবদিহি করা, দুর্নীতি দূর করা এবং গণতন্ত্রকে সত্যিকারের জনগণের পক্ষে কাজ করতে সক্ষম করতে হবে এই তো ছিল মূল কথা, কিন্তু তা হলো কই ?

কিন্তু জনহিতায়, জনসুখায় গণতন্ত্রের আদর্শ ছেড়ে শাসকের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যে হঠাৎ আমরা এত বিশ্বাসী হয়ে উঠলাম কেন, তার উত্তর কি আমাদের কাছে আছে? কিছুদিন আগেও  যারা মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিশ্বের যাবতীয় সমস্যাকে বিশ্বনাগরিক হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতির কুশপুত্তলিকা দাহ করে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতেন,দেশের গণতন্ত্র যখন বিপন্ন, মানবাধিকার যখন লঙ্ঘিত, শাসক যখন উলঙ্গ তখন কোথায় বলতে পারছি কউভ "রাজা, তোর কাপড় কোথায়? "

মনে পড়ে,আব্রাহাম লিংকনের সেই অমোঘ উক্তি, ‘জনগণের চেতনা দ্বারা কিছুই ব্যর্থ হতে পারে না, বরং এটা ছাড়া কিছুতেই সফল হওয়া যায় না। আজ যদি এই প্রশ্ন গুলোকে এড়িয়ে যাই, নিরুত্তর ছবি হয়ে থাকি, আগামীর কাছে তো জবাবদিহি করতেই হবে। সেখানে কিন্তু কোনো ছাড় পাবো না।

তাহলে এই বিশ্বকে আগামীর বাসযোগ্য করে যাবো আমি, নবজাতকের কাছে এই অঙ্গীকার আমার রক্ষা হলো কই?

1 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন