অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
‘ত্রিশ বছর আগেকার সময়’ – একথা বলতে এখন আর ১৯৭০ বোঝায় না। ১৯৯০ বোঝায়। আমরা যারা নব্বই দশকের দামাল, ভাবতে অবাক বোধ হয় সেই আমরাও কিনা ত্রিশ পেরিয়ে এখন মধ্য-ত্রিশের আঙ্গিনায় পা দেবার তোড়জোড় চালাচ্ছি। তবুও মনে পড়ে আমাদের ছোটবেলা। এখনকার যে সময় অন্যরকম। ডিজিটাল যুগের দাপটে ছুঁয়ে দেখা, কানে শোনার ধরণটুকু পালটেছে অনেক। এখনকার শৈশব দেখে অনেক, মনে রাখে কম। আমরা বোধহয় পেতাম অল্প, তাই ভালো লাগার রেশটুকুও মনে থেকে যেত অনেকদিন।
‘যোশী, ভীমসেন’কে নিয়ে লিখতে বসলে, সে কাজ ধৃষ্টতা বলে মনে হয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অল্প। তান-রাগ-ঠাট-বাহারের প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ আমার কক্ষপথের বাইরে। সঙ্গীতের সঙ্গে আমার যোগাযোগ সীমাবদ্ধ কেবল শুনে ভালো লাগার ক্ষেত্রতেই। তবু সেই যোগাযোগ একেবারে অনিয়মিত নয়। বেশ মনে পড়ে খুব ছোটবেলায় বড়দের হাত ধরে টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন ছাড়িয়ে উত্তমকুমারের মূর্তির ওদিকটায়, সঙ্গীত রিসার্চ এ্যাকাডেমির অনুষ্ঠান শুনতে যেতাম। সেইখানেই মনে পড়ে, প্রায় শতায়ু এক ভদ্রলোকের গান শুনেছিলাম। উস্তাদ আবদুল করিম খান নাম ছিল বোধহয়। অত বয়সেও অমন মধু-ঢালা কণ্ঠস্বর আচ্ছন্ন করত আমায়। সুর-স্বর-বেহাগ-আলাপ না বুঝলেও, ভালো লাগত। ওখানেই প্রথম শোনা পণ্ডিত উল্লাস কশলকর, এবং উস্তাদ বিলায়েৎ খান সাহেবের কলকাতায় শেষ অনুষ্ঠান। বোধহয় সেই অনুষ্ঠানের একমাসের ভিতরেই উস্তাদজি প্রয়াত হন। কাজেই, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত না বুঝলে উপভোগ করা যায় না – একথা অবিশ্বাস্য। সঙ্গীতের স্পর্শ নিতে কেবল সরল, উদার মনটুকুই যথেষ্ট বলে মনে হয়। তারও পরবর্তীতে আসবেন ভীমসেন স্বয়ং। আমাদের নব্বই দশকের শৈশবে যার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি থেকে যায়। অবিচ্ছিন্ন, অনেকদিক থেকেই।
ভীমসেন বলতেই মনে পড়ে ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’র প্রায় অলৌকিক সেই আহ্বান। যে আহ্বান কেবল অলৌকিক নয়, কেমন যেন তা রক্তের সঙ্গে, মনের সঙ্গে অজান্তে মিলে যাওয়া এক সুর। মিলিয়ে দেবার সুর। আমাদের ছোটবেলায়, বিশেষত যাদের বাড়িতে দূরদর্শন ভিন্ন অন্য কেবল-চ্যানেলগুলির সংযোগ ছিল না, ডিডি’র কল্যাণে প্রায়শই কানে ভেসে আসত ভীমসেনের কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতা দিবস অথবা প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে বিসমিল্লার সানাইয়ের সুর, অনুষ্ঠান-শেষে ভীমসেন যোশীর গান। ঐক্যের আহ্বান। মিলেমিশে একত্রতার অভিবাদন। এখন সেই দেশ অনেকটা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ভীমসেনেরও মন ভালো নেই বোধহয়।
আমরা বরং সেই ম্যাজিক সময়টুকুকেই ফিরে দেখি চলুন।
১৯৮৮ সালে লোকসেবা সঞ্চার পরিষদ ও জাতীয় দূরদর্শনের যৌথ উদ্যোগে দেশব্যাপী ঐক্য প্রচারের উদ্দেশ্যে একটি গান ও ভিডিও নির্মাণের কথা ভাবা হয়। শোনা যায়, তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, অন্ধ্রপ্রদেশের বিধায়ক কোনা প্রভাকর রাও, ও জনৈক জয়দীপ সমর্থ (যিনি আবার অভিনেত্রী তনুজা ও নূতনের অগ্রজও বটে), তাদেরই মনে প্রথম এমন একটি গান তৈরির বিশদ ভাবনা জন্ম নেয়। যদিও তাদের ভাবনা থেকে, সত্যি সত্যি সেই ভাবনার গান হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে পথ বাকি ছিল অনেকটাই। জয়দীপ সমর্থ এই বিষয়ে প্রথম কথা বলেন সুরেশ মল্লিক ও সুরকার কৈলাস সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে। তাঁরাই জয়দীপকে বলেন এই বিষয়ে সবচেয়ে আগে যাঁর কাছে যাওয়া উচিত, প্রশ্নাতীত ভাবে তিনি ভীমসেন – ভীমসেন যোশী স্বয়ং। এককথায় সম্মতি দেন পণ্ডিত। তাঁরই পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, নতুন এই গানটি হবে কর্ণাটকী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে আধুনিক, সমকালীন সঙ্গীতের এক মিলিত রূপনির্মাণের উদাহরণ। মূলাধার হিসেবে থাকবে রাগ ভৈরবীর প্রয়োগ। পীযূষ পাণ্ডেকে গীতিকার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। নয় নয় করে ১৭টি খসড়া বাতিল হওয়ার পর, অবশেষে অষ্টাদশতম খসড়াটিকে ভীমসেনের পছন্দ হয়। গানটির সঙ্গীত-নির্মাণ, যন্ত্রানুষঙ্গ ও ভিডিও নির্মাণের ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন লুই ব্যাঙ্কস ও এল বিদ্যানাথনের মতো মানুষ। মূল গানে গলা মেলান লতা মঙ্গেশকর, এম বালামুরলীকৃষ্ণ এবং অবশ্যই পণ্ডিত ভীমসেন যোশী। মূল যে মিউজিক-ভিডিওটি এই সূত্রে তৈরি করা হয়, ভীমসেনের গানের দৃশ্যতেই তার সূত্রপাত।
একদিক থেকে দেখলে এই ভিডিওটি আমাদের কাছে আমাদের ছোটবেলারও এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থেকে গিয়েছে – বিশেষ করে ভিডিওটির শেষদিকে যখন, আমাদেরই গর্বের শহর কলকাতার, গর্বের মেট্রো-কামরা থেকে একে একে নেমে আসতে দেখা যায় মৃণাল সেন, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী গোস্বামী অথবা অরুণলালের মতো প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বদের। অথচ এই ভিডিওর শ্যুট করতে গিয়েও বিশেষ বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন প্রযোজক সুরেন্দ্রনাথ। ভারতীয় বায়ুসেনার তদানীন্তন এক আধিকারিকের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় থাকায়, সুরেন্দ্রনাথ সেই সূত্র ব্যবহার করে ভারতীয় বায়ুসেনার হেলিকপ্টারে চেপে তাজমহলের মাথার উপর থেকে বিশেষ কায়দায় ছবি তোলার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে এই খবর জানাজানি হলে, সেই আধিকারিককে এই বিষয়ে সেনাবাহিনীর কাছে কারণ দর্শাতে হয় এবং একই সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথও আর্থিক দণ্ডের মুখে পড়েন। এই সবকিছুকে ছাপিয়ে আমাদের মনে থেকে যায় কোদাইকানালের স্বচ্ছ সেই ঝর্ণার প্রেক্ষাপটে ভীমসেন যোশীর গান – ভোরের গন্ধ মাখা কণ্ঠস্বর, “মিলে সুর মেরা তুমহারা!”
“…তো সুর বনে হমারা! মিলে সুর…”
*সেই ঝর্ণাটিকেও কি পরিচিত বলে মনে হয় আপনাদের? আমাদেরই ছোটবেলার আরেক জনপ্রিয় লিরিল সাবানের বিজ্ঞাপন, সেই স্বচ্ছ সবুজ ঝর্ণার জলে লিরিল-গার্লের দাপাদাপি – সেই বিজ্ঞাপনটিরও শ্যুটিংয়ের জন্য কোদাইকানালের সেই বিশেষ ঝর্ণাটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। যে কারণে পরবর্তীতে লোকমুখেও সেই ঝর্ণার নাম ‘লিরিল ফলস’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
ভীমসেন বলতেই তাই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাইরেও এত রঙ, এত বর্ণের ঝলক। মধ্যবয়সে পা দিতে চলা গোটা এক প্রজন্মের কাছেই তিনি নস্টালজিয়ার অনুরণন। ‘ভারতরত্ন’ অথবা অন্য কোনও পুরষ্কারের বিচারে তাঁকে পরিমাপ করা চলে না। ধারওয়াড়ের সওয়াই গন্ধর্বের শিষ্য তিনি, পরবর্তীতে যিনি নিজেই নিজেকে সঙ্গীতমার্গের এক সাক্ষাৎ গন্ধর্বের পর্যায়ে অনায়াসে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের জীবনের অন্তিম সময় অবধি গুরুর নামে আয়োজন করে এসেছেন সওয়াই গন্ধর্ব সঙ্গীত সম্মেলন। ২৪শে জানুয়ারি, ২০১১ – ভীমসেনের মৃত্যুর পর অনুষ্ঠানের আয়োজকদের তরফে এই সঙ্গীত সম্মেলনের নতুন নামকরণ করা হয় ‘সওয়াই গন্ধর্ব ভীমসেন মহোৎসব’।
মূলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধারে থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে ‘মিলে সুর’এর বাইরেও ভীমসেনের পরিচিতি ছিল। ১৯৫৬ সালে ‘বসন্ত বাহার’ ছবিতে মান্না দে’র সঙ্গে একটি গানে তিনি গলা মিলিয়েছিলেন। মরাঠি ছবি ‘স্বয়ংবর জ্বালে সিতেচে’ (১৯৬৪) অথবা কন্নড় ছবি ‘সন্ধ্যারাগ’ (১৯৬৬), তেমন একেকটি পরিসরেও তিনি গান গেয়েছিলেন। শেষোক্ত ছবিতে ভীমসেনের সঙ্গে আরেক দক্ষিণী নক্ষত্র এম বালামুরলীকৃষ্ণকেও গলা দিতে শোনা যায়। পণ্ডিত যশরাজের সঙ্গে ১৯৭৩ সালে ভীমসেন যোশী ‘বীরবল মাই ব্রাদার’ ছবিতে সঙ্গীত উপস্থাপন করেন। মালকৌঁষ রাগে সেই গান এখনও সামাজিক মাধ্যমে উপলব্ধ। ১৯৫৮ সালে বাংলা ছবি ‘তানসেন’ ও ১৯৮৫ সালে হিন্দি ছবি ‘আঁখি’তেও তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ‘আঁখি’তে সঙ্গীত পরিবেশনের কারণে ভারতীয় চলচ্চিত্র-ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে ভীমসেন যোশী সে বছরের জাতীয় পুরষ্কারে সম্মানিত হন। খেয়াল-ঠুমরি-দরবারি’র বাইরেও তাই ভীমসেনের অবারিত জগৎ।
তিনি গাড়ি চালাতে ভালোবাসতেন। সেই প্রেম এতটাই ছিল যে অনেকসময়েই বাসস্থান পুনে থেকে কাছাকাছি শহরে জলসার আয়োজন হলে নিজেই গাড়ি চালিয়ে সেই জলসায় গাইতে হাজির হতেন ভীমসেন। পরিচিতজনেদের বয়ান থেকে জানা যায়, কমবয়সে একবার এভাবেই গাড়ি চালিয়ে, পুনে থেকে মুম্বাই, সেখান থেকে বেলগাম, শোলাপুর, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ, নাগপুর হয়ে তারপর একেবারে ছত্তিশগড়ের রায়পুর অবধি গিয়ে সে যাত্রায় জলসা-সফর শেষ করেছিলেন ভীমসেন। গাড়ি চালানোর সময় গতি তোলাতেই ছিল তাঁর আনন্দ। সময়ে সময়ে দুর্ঘটনার হাত থেকেও কোনওমতে বেঁচে ফিরতেন। তবু ভীমসেনের গতির প্রতি টান কমত না। বোধ করি তাঁর দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠতে চাওয়া লয়কারির জলুসকেই তিনি তাঁর হাতের স্টিয়ারিংয়েও তুলে আনতে চাইতেন। ক্রমশ দেশ জুড়ে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায়, অবশেষে ভীমসেন তাঁর সাধের মার্সিডিজ গাড়িটিকে দূরে সরিয়ে রেখে বিমানযাত্রায় সম্মতি জানাতে বাধ্য হন। পরিচিত কেউ এই গাড়ির বিষয়টিকে নিয়ে রসিকতা করে পণ্ডিতজিকে বলেছিলেন, “সওয়াই গন্ধর্বের শিষ্য তুমি – এখন দেখছি ‘হাওয়াই’ গন্ধর্বে রূপান্তরিত হয়ে বসেছ!” এও মনে রাখতে হবে, কেবল গাড়ি চালানোই নয় – তার কলকব্জার বিষয়েও পণ্ডিতজির জ্ঞান ছিল চোখে পড়ার মতো। জীবনে তিনি যা কিছুই করেছেন, নিষ্ঠার সঙ্গে তাতে মন-প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন, আর সেই জন্যই তিনি সকলের মধ্যে থেকেও বিরাট হয়ে উঠেছিলেন, তৈরি করেছিলেন নিজস্ব এক জগৎ।
তিনি বলেছিলেন, “মার্সিডিজের চেয়ে ভালো গাড়ি হয় না আর!”
শেষ বয়স অবধি সওয়াই গন্ধর্ব সঙ্গীত সম্মেলন নিজে হাতে পরিচালনা করেছেন। অন্তিম অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে তিনি নিজেই সেই মঞ্চে গাইতে বসতেন। এরপর, বিগত কয়েক বছর যাবৎ সেই আসনে বসছিলেন বিদূষী প্রভা আত্রে। এবছরেরই জানুয়ারি মাস। তিনিও পরপারে পাড়ি দিয়ে গেলেন। আমাদের পৃথিবীতে সঙ্গীত কমে আসতে শুরু করেছে। আমরা অনেক বেশি ‘জিঙ্গল’এ বিশ্বাসী এখন। সময়ের প্রতি আস্থা নেই আমাদের। ছুটতে গিয়ে আমরা সাধনার গুরুত্বকেও ভুলে যাচ্ছি? নাকি যাচ্ছিও না বোধহয়? সবসময় ঋণাত্মকে শেষ করতে নেই।
যে তানটুকু ভীমসেন শুরু করে দিয়ে গেছেন, কোথাও বা বিলম্বিত …
সেই মার্সিডিজ এখনও ছুটছে ঠিক – গুরু ভীমসেনের প্রতিই শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই,
“একদিন এই সুর আবারও সমে পৌঁছবেই!”
এতো সমৃদ্ধ পূর্ণ লেখা অবাক হয়ে গেলাম, চমৎকার চমৎকার চমৎকার
উত্তরমুছুন