অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
নভেম্বর, ১৮৭৬। কার্তিক পূর্ণিমার রাত। জল ভেঙে, কাদা ডিঙিয়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা একেকজন গ্রামের ভিতরে ঢুকে আসেন। সম্পূর্ণ বানের জল তখনও নামেনি। ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে শব। গবাদিপশুর দেহ। এখনও সেগুলি পচে, ফুলে উঠতে শুরু করেনি। ফটফটে জ্যোৎস্না চকচক করছে। বাখরগঞ্জের ঘূর্ণিঝড়। দানা’র কারণে গরীবগুর্বোদের মাটির ঘর ভাঙল না বলে যে সকল দুপেয়ে জীব সামাজিক মাধ্যমে আকুতি বিলিয়েছেন, এই বর্ণনাটুকু তাঁদের উদ্দেশ্যে। ১৮৭৬এর ৩০ অক্টোবর বাখরগঞ্জের যে অতি-তীব্র ঘূর্ণিঝড় বাংলার বুকে আছড়ে পড়েছিল, মানমন্দিরের তথ্য অনুযায়ী তার সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠেছিল প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার।
দীপাবলির রাত।
এই সময়টায় ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করে। ভোরের দিকে অল্প শিরশিরে ভাব। দুপুর-বিকেলে শুকনো ধুলোর উপদ্রব। চিটচিটে ঘামের উৎপাত আর অনুভব করা যায় না। সরকারি-বেসরকারি অফিসকর্মীরাও মনে মনে ভাবতে শুরু করেন, ক্যালেণ্ডারের হিসেবে আরও একটা বছর কাটল। দশমাস পেরিয়ে, পিছনে ফেলে আসা শ’তিনেক দিনরাত, তারও সঙ্গে গণ্ডা-পাঁচ অমাবস্যা-পূর্ণিমা, সপ্তমী, একাদশীর হিসেব। ফিরে দেখতে ইচ্ছে হয়।
অথবা হয়ও না বোধহয়।
দীপাবলির মুক্তগদ্য কি সমকালকে উদ্দেশ্য করে হওয়া উচিত? নাকি চিরকালীন বিস্তৃত সময়, গড়পড়তা আবেগ অথবা বহুকাল যাবৎ চলে আসা স্মৃতিচর্বণের, সাহিত্য-রোমন্থনের চিরায়ত ঐতিহ্য মেনেই গতানুগতিক গদ্য-চালনার অভিমুখে তার প্রথাগত ভবিষ্যৎ? অন্তত সাম্প্রতিক বছরে অন্যথা হোক তার। দ্রোহের এই সময় সবিশেষ কিছু বলুক। এই দীপাবলি আমাকে আলোর অভিমুখে নিয়েছে। এই দীপাবলির মূল বৈশিষ্ট্য তাই সমগ্রতার দিক থেকে তার অনন্য হয়ে ওঠায়।
সমগ্রতার কথা এসে পড়ল। যে কোনও উৎসবের সার্থকতা তার সমগ্র হয়ে ওঠায়। গুরুদেব এমনি এমনি বলেননি “আমার উৎসব সকলের উৎসব হউক।” মিলনের বহুত্বেই উৎসবের উদযাপন। চব্বিশ সালের এই দশমাস, কমবেশি চল্লিশ সপ্তাহের হিসেব, এই সময়ে আমরা যে উপমহাদেশব্যাপী দ্রোহকাল পেরিয়েছি তারই সাপেক্ষে আমরা সেই গভীরতর সমগ্রতাকে উপলব্ধি করতে চাই। সেই অনুভবেই দ্রোহের সাফল্য। উৎসবের সবদিক থেকে সার্থক হয়ে ওঠা।
দীপাবলির উৎসব আলোর উৎসব যখন, তখন গভীরতম অন্ধকারের সময়েও তার বিপরীতে যে হাজার আলোর ঝলকানি দেখা যায় তার বিষয়েই কথা বলা উচিত। দ্রোহকাল সেই আলোর উদযাপনের একটি দিক। আরও একটি দিক রয়েছে তার। দ্রোহের সময় যারা কাছ থেকে সেই সময়কে অনুভব করল, হাত ছুঁয়ে দেখতে চেষ্টা করল, মানসিক ভাবে, অন্তর থেকে যারা তার ভাগীদার হতে চেষ্টা করল – তাদের কপালে অতিরিক্ত আরও এক প্রাপ্তি জুটল। আরও একটিবার তারা অনুভব করল বহুস্বর। সমাজের গভীরে বিভাজিত অথচ একে-একে জুড়ে থাকা, কাছাকাছি লেগে থাকা - বহুস্তর। যে মানুষগুলোকে আমরা আলাদা করে দেখিনি। আলাদা করে তাঁদের দেখা যায় না। তাঁরা মানুষে মিশে থাকেন।
তিলোত্তমার প্রতি হওয়া অন্যায়ের সঠিক বিচারের দাবিতে শুরু হওয়া আমরণ অনশন আন্দোলন যেদিন উঠল, অন্যান্য দিনগুলোর মতোই সেই চত্বরে উপস্থিত ছিলাম। আন্দোলন উঠবে এই মনোভাব তখন ক্রমশই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। চেনা স্বর কানে এল। চেনা মুখ তাকিয়ে দেখলাম। কান পেতে কথাগুলো শুনছিলাম। লোকটি সর্বস্ব দিয়ে খেটেছে এই কদিন। নেহাতই সহনাগরিক কেউ। ‘সহনাগরিক’ তকমাতেও বোধহয় অনেকে তাকে ডাকবে না। এরা আমাদের চোখে অদৃশ্য হয়ে থাকে।
কিন্তু এদের অনেকের হৃদয়ের যে চূড়ান্ত অকৃত্রিমতা, আমাদের অনেকেরই বিবেককে তা লজ্জা দেয়। লোকটি বুঝলাম কোনও বিমা কোম্পানির কর্মচারী। সেপ্টেম্বরের ত্রৈমাসিক ফুরিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ব্যবসায়িক লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। তারই মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে আন্দোলন। চাকরির কথা না ভেবে, উৎসব দূরে থাক, লোকটি আন্দোলনে ঝাঁপিয়েছে। কেউ তার সাক্ষাৎকার নেয়নি। টিভির পর্দাতে বারকয়েক দেখা গেলেও, আন্দোলনের মুখ সে কখনই হয়ে উঠতে পারেনি। সে কেবল অক্লান্ত খেটে গিয়েছে।
আন্দোলন আপাতত উঠে যাচ্ছে। লোকটি একের পর এক ফোন করে চলেছে। প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে অনেকে ঘুরিয়েছে অনেকবার। তাঁদেরই কেউ যদি, প্রতিশ্রুত অর্থের অন্তত কিয়দংশও এই মুহূর্তে বিনিয়োগে সম্মতি জানান, তার চাকরিটা হয়তো থাকবে। না দিলে থাকবে না। লোকটি অম্লানবদনে একাধিবার সেই সত্য উচ্চারণ করে। তার ভাবের কোনও পরিবর্তন হয় না।
লোকটি চিন্তাগ্রস্ত, কিন্তু সেই চিন্তাকে সে সামনে আসতে বাধা দিচ্ছে। তার হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে, এই লড়াইয়ের কারণে ব্যক্তিগত পরিসরে যদি এত বড় সংকটও তার জীবনে নেমে আসে – তার জন্য কখনই সে নিজের অদৃষ্টকে দোষী করবে না। অথবা এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতে চাইবে না, “কোন অন্যায়ের কারণে আমার এই শাস্তি!” লোকটি বড় সহজ হয়ে সত্যকে ধারণ করেছে। লোকটি আন্দোলনে থাকবে। যতদিন না সে যূপকাষ্ঠে সম্পূর্ণ নিষ্পেষিত হয়। এদের কোনও জন্ম নেই। এদের বোধকরি মৃত্যুও হয় না আর।
হেমিংওয়ে যেমনটা লিখেছিলেন, “a man can be destroyed but not defeated”,
দধীচির হাড়সম এরা বেঁচে থাকে।
মেট্রোয় ফিরছিলাম। কানে গান ভেসে এল। চাপা, তবু স্পষ্ট স্বর। আওয়াজ অনুসরণ করে দেখলাম দরজার পাশটিতেই দাঁড়িয়ে একজন। কাঁধে অফিসের ব্যাগ, ঘাম-চপচপে দেহ। কানে লাগানো ইয়ারবাড। তবু সে গাইছে। বড় স্পষ্ট গান। কান পেতে খানিক শুনতে বুঝলাম, রাগ ইমন। এমন সময়েই সে রাগ গাইতে হয়। চলন্ত মেট্রোতেও সে মানুষটি রেওয়াজে মত্ত। ছুটে চলা মেট্রোর শব্দ, আশেপাশের মানুষজন, প্রতিটি স্টেশনে দরজা খোলার পর মানুষের ওঠানামা, এমন কোনও কিছুই তাকে বিচলিত করছে না। কেবল একমনে তার গান চলছে। কখনও দ্রুত, কখনও বিলম্বিত। একেকসময়ে তানের ঝংকার, তেহাইয়ের কেরামতি, অথচ কোনও বাহ্যিক প্রকাশ নেই। কোনও উত্তেজনা নেই। কেবল নিস্তব্ধ, নীরব অনুশীলন। এই একাগ্রতা আমাদের অভিভূত করে। আমরা কোনওদিন এতখানি একাগ্র হতে পারব না। ট্রেন থেকে নেমে আসতে পিছনে ফিরে তাকালাম, গান থামেনি। গান চলবে আরও কিছুক্ষণ।
দধীচির হাড়ের কথা বলছিলাম। দ্রোহকালের আরও কয়েকটি মুখ আমার আজীবন মনে থাকবে। মাতৃআরাধনার ক্ষেত্রে আমি মন্দিরে বিশ্বাস করি না। সাধনপীঠের আসনে আমার কোনও ভরসা নেই। তবু মায়ের মুখ নতুন করে মিছিলে দেখেছিলাম।
দুইজনকে মনে পড়ছে খুব। তাঁদের মধ্যে একজন সংসারত্যাগী, থানকাপড় পরিহিতা। হাতের ছোট্ট বেতের বাক্সে বালগোপাল। অন্যজন একেবারেই আলাদা করে চোখে পড়ার মতো নন। সাধারণ আটপৌরে অবয়ব। অনশনের প্রতিটি দিন এঁরা নিয়ম করে এসে দাঁড়াতেন। রোদ-জল-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ব্যারিকেডের ওধারে ঠায় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতেন। আর সারাদিনের কোনও এক সময় মঞ্চে অনশনকারীদের কাছ অবধি পৌঁছিয়ে ভক্তি ভরে তাদের মাথায় ঠেকিয়ে দিয়ে আসতেন কয়েকটি প্রসাদী ফুল। সেই সময়গুলোতে কাছাকাছি থাকলে আমার কপালেও সেই পরশ জুটত। আর কখনও হয়তো তাঁদের সঙ্গে আমার দেখা হবে না। অথচ সম্পূর্ণ অচেনা কেউ, আরেকজন অচেনা মানুষের জন্য এতখানি অকৃত্রিম ভাবে কল্যাণ প্রার্থনা করতে পারেন – না দেখলে হয়তো কোনওদিন তা বিশ্বাস করতাম না। আমার আজীবনের জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজন ফুরল।
আমি মানবদেবতাকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি। তাঁর দুহাতভরা আশীর্বাদ পেয়েছি। তাঁদের হাসিমুখ, অকৃত্রিম কুশল জিজ্ঞাসা, সেই মাতৃমূর্তি তো মানুষেই বিরাজে ঠিক। এই বিশ্বাস আর কোনওদিনও হারাবে না। কত মানুষকে দেখেছি। তাঁরা আমাদের মতো একেকজনের হাত ধরে কেঁদেছেন। অঝোরে কেঁদে গিয়েছেন। আমরা সান্ত্বনা দিতে পারিনি। এঁদের দল-মত-ধর্ম-গোষ্ঠী হয় না। এঁরা একেকজন এখনও রয়েছেন বলেই সম্পূর্ণ পৃথিবীটা দান্তের নরকে পরিণত হয়নি। এঁদের অস্তিত্ব এখনও সত্য বলেই, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ!” রবীন্দ্রনাথ সত্য উচ্চারণ করেছিলেন।
দীপাবলির ঈশ্বরকে মন্দিরে খুঁজতে নেই। মানুষের মনুষ্যত্বেই এই আলোর উদ্ভাস চিরকালীন। চব্বিশের দীপাবলি আমাদের আলোর অভিমুখে ফেরাল। যদিও সেই অভিমুখ আমরা বজায় রাখতে পারব কিনা, উত্তর পাঠাবে ভবিষ্যৎ।
খুব সমৃদ্ধ পূর্ণ মুক্তগদ্যটি । অসাধারণ
উত্তরমুছুন