
রবীন বসু
পাকা ধানে মাঠ ভরে আছে। কেমন দুধ দুধ গন্ধ। যতদূর চোখ যায় যেন হলুদ চাদর বিছানো। অর্ক সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে সাইট দেখতে। আসলে সে একজন কৃষিবিজ্ঞানী। সুন্দরবন লাগোয়া এই নিমপীঠ অঞ্চলের সরকারি কৃষি ফার্মের দায়িত্বে আছে। গবেষণা করে উচ্চ ফলনশীল ধানের বীজ তৈরি করা ও সেগুলো চাষিদের মধ্যে বিতরণ করা তাদের কাজ। কী সার দিতে হবে, কী কীটনাশক কখন কতটা স্প্রে করলে ফলন বাড়বে তার গাইড লাইন দেয়।
আশ্বিন চলে গেছে, এখন কার্তিক মাস। অর্থাৎ হেমন্ত ঋতু পৃথিবীতে। বাতাসে শুকনো ভাব। গাছের পাতা হলদে হচ্ছে। এবার ধান কাটা শুরু হবে। ফসল ভরা মাঠের দিকে তাকিয়ে অর্কর মনে পড়ল কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু শিশিরের জল’। আর এই কবিতার কথা মনে আসতেই তার মনে পড়ল, ধানসিঁড়ির নাম। জীবনানন্দের কবিতা খুব ভাল আবৃত্তি করে। একদিন ফসলহীন মাঠে নাড়ার উপর দাঁড়িয়ে প্রথম কবিতা শুনিয়েছিল অর্ককে। এই অঞ্চলের মেয়ে। কলেজে পড়ে। আবার বয়স্ক বাবার জমিতে ট্রাক্টর চালিয়ে চাষ করে। নিজের হাতে ধানচারা পোঁতে। কোমরে গামছা বেঁধে ধারালো কাস্তে দিয়ে পাকা ধান কেটে খামারে তোলে। কৃষি ধান আনতে সেন্টারে গিয়েছিল। সেখানে আলাপ। পঞ্চায়েতের একজন বলেছিল, ও খুব ভাল মেয়ে। পড়াশোনায় ভাল, বুদ্ধিমতী। এবছর আবৃত্তিতে জেলার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে, স্যার। অর্ক অবাক হয়। এই সাদামাটা চেহারার সাধারণ একটা গ্রাম্য মেয়ের মধ্যে এত গুণ! তখন থেকেই ধানসিঁড়ির প্রতি অর্ক কেমন একটা টান অনুভব করে।
একদিন বিকেলে হঠাৎই সেন্টারের সামনে ধানসিঁড়ির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ও সাইকেলে কোথায় যেন যাচ্ছে। অর্ক ওকে হাতের ইশারায় থামায়। সাইকেল থেকে নেমে ধানসিঁড়ি জানতে চায়, কিছু বলবেন, স্যার।
—তোমার সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই।
— বেশ তো, আমি মাঠের দিকে যাচ্ছি। আসুন কথা বলতে বলতে যাই।
সেই শুরু। তারপর একটু একটু করে গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত ও বসন্তে অর্ক ধানসিঁড়িকে কত রূপে দেখেছে। কত কথা, কবিতা শুনেছে। তার সাধারণ আটপৌরে চেহারা কখন যে আশ্চর্য মোহময়ী হয়ে উঠেছে তার কাছে, সে নিজেই বুঝতে পারেনি। কয়েকবার স্বপ্নে সে ধানসিঁড়িকে দেখেছে।
বেশ জোরে কে যেন সাইকেলের ঘণ্টি বাজাচ্ছে। অর্ক একটু থামে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ধানসিঁড়ি জোরে সাইকেল চালিয়ে তার দিকে আসছে। কিছুক্ষণ পর ও এসে গেল। সাইকেল থেকে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কতক্ষণ আপনাকে খুঁজছি। সেন্টারে গিয়েছিলুম। শেষে দেখি আপনি মাঠের দিকে আসছেন।
—কিন্ত আমাকে খুঁজছো কেন?
—একটা খবর দেয়ার আছে।
অর্ক কৌতূহলী হয়। —হ্যাঁ, বলো। কী খবর?
—জানেন স্যার,আমার না বিদেশে পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করব বলে অ্যাপ্লাই করেছিলাম। পরীক্ষার অনেক স্টেপ পেরিয়ে অবশেষে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। সামনের মাসেই যেতে হবে।
অর্ক কী বলবে! হেমন্তের মাঠে হলুদ ধান ভরে ছিল। কোথাও ফিঙে ডাকছিল। তিতির উড়ছিল। সেই মাঠ এবার ফসলহীন হবে। ধান গোলায় উঠে যাবে। শূন্য মাঠে পরিত্যক্ত খড়ের ভিতর ইঁদুরের লাফালাফি। ধূসর কুয়াশায় ভরে গেল অর্কর মন। তার চোখে শুধুই প্রগাঢ় শূন্যতা। ধানসিঁড়ি অবাক হয়ে চেয়ে থাকে অর্কর কুয়াশাভেজা চোখের দিকে!