মালবিকা মিত্র
ভঅ গঅ ভগ, বঅ তয়ে ঈ বতী, ভগবতী। দয়ে একার বয়ে ঈকার দেবী, ভগবতী দেবী। ছয়ে একার লয়ে একার কয়ে একার ছেলেকে, বঅ লঅ লয়ে একার দন্তন্য বললেন। ভগবতী দেবী ছেলেকে বললেন....।
আমার মা শয্যাশায়ী তিন বছরের বেশি সময়। তাঁর আয়া সুলতা। আসল নাম ছিল সুলতানা। ওই নামে কোথাও কাজ পাওয়া যায় না। তাই আমিই ওকে আদর করে সুলতা ডাকি। ওরও সুবিধা, আমারও। বাড়ি তে নিত্য আত্মীয় প্রতিবেশীর আনাগোনা। নামটা তাদের কানেও বেসুরো ঠেকে না। বিশেষত দেশনেতারা যখন খাদ্য পোশাক নাম ইত্যাদি দিয়ে চিহ্নিত করেন। তাই নাম পরিচয়ের ওপর বেশি পীড়ন করাও হলো না। মায়ের টুকিটাকি কাজ ছাড়া ও বেশিরভাগ সময়ই ঝিমিয়ে টিভি দেখে কাটায়। আমিই সুলতা কে প্রস্তাব দিলাম, এই সময়টা পড়াশোনা শিখতে পারিস তো। একটু অক্ষর জ্ঞান, একটু বাংলা পড়তে পারা। এতে আরও একটু ভালো কাজ পাবি। এখন আমি ওষুধ খাওয়াই। একটু পড়তে শিখলে সকালে... রাতে.... খাবার আগে... খাবার পরে.... খালি পেটে.... লিখে দিলে তুই নিজেই খাওয়াতে পারবি। প্রস্তাবটা ওর মনে ধরলো। "তুমি শেখাবে দিদি? ইয়াহুউউ। শ্লেট, পেন্সিল, আদর্শ লিপি, বর্ণপরিচয় নিয়ে সে এক যুদ্ধ শুরু হলো।
প্রথমটায় খুবই হোঁচট খাচ্ছিলাম। কিন্তু জানতাম ওর বয়স ৩৮/৪০ বছর। বয়স্ক শিক্ষায় শুরুটা মসৃণ নয়, বন্ধুর পথ। কিন্তু একবার যুক্তিটা বুঝতে পারলে মজা পেয়ে যাবে। সেই সূত্র : বাহির থেকে বল প্রয়োগ না হলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির ও সচল বস্তু সমবেগে সরলরেখায় চলতে থাকবে। একটা জড়তা বিরাজ করে। আবার জড়তা কেটে গেলে সে আপনিই গড়াতে থাকে। হলোও তাই। প্রথম দিকে একটাই কথা, "ছেড়ে দাও দিদি, আমার হবে না"। কিছুদিনের মধ্যেই গোগ্রাসে গিলতে লাগলো সশব্দে বানান করে। ঠোঙা, বিজ্ঞাপনের লিফলেট, খবরের কাগজ, দোকানের সাইনবোর্ড সবকিছু। কাবাবের মজা নিতে গেলে মাঝে মধ্যে মুখে হাড্ডি পড়বেই, রস ভঙ্গ হবেই। স্থান কালের তোয়াক্কা না করে সশব্দে পড়তে থাকে জাপানী তেল, ঋতু বন্ধ, আকথা কুকথা সব। অগত্যা সহজ ভাষায় ছোটোদের জন্য লেখা মনীষীদের জীবনী কিনে এনেছি বইমেলা থেকে। সেই বই নিয়ে চলছে লড়াই। তখন বিদ্যাসাগর পড়ছিল, শুনতে পেয়েছন তো? বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি।
কথাটা হলো হসন্তের উচ্চারণ নিয়ে বিরাট সমস্যা। লঅ নঅ এর উচ্চারণ সহজ। চল যাই, কত পাতা, পড়া সহজ। চাল ডাল পান খাল বিল এসব পড়া কঠিন। কারণ এগুলো হসন্তের উচ্চারণ। যাই হোক, জানি পড়তে পড়তে এই সমস্যা কাটবে। প্রতি দিন মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ে। কি পড়লো আমাকে জানায়। বিরাট কোহলির রানের খরা কাটলো, সৌরভ বোর্ড সভাপতি পদ ছাড়লো, মেসি গোল করলো, ঝুলন গোস্বামী, সব খবর পাই সুলতার কাছে। রাজনীতির খবর, দুর্ঘটনা, খুন ধর্ষণ, সবই পড়ে।
-- আজ মমতা দিদির বাজেট, বাজেট কি দিদি ?
-- আবার আমি বোঝালাম, আমরা মাসের শুরুতে হিসেব করি কোথা থেকে কতো আয় হবে। সেই অনুযায়ী ঠিক করি কোথায় কতো খরচ করবো। সরকার বছরের শুরুতেই হিসেব করে কোথা থেকে কতো আয় হবে, কতো খরচ হবে। এটাই বাজেট। আমি ওকে বোঝালাম। আমাকে খবর পড়ে শোনায়। কখনো খবর পড়ে নিজের ভাষায় বলে শোনায়। পরখ করি ঠিক বুঝলো কিনা।
মোহনবাগান শব্দটা খুব সহজে পড়তে পারে, কিন্তু ইস্টবেঙ্গল একটু বেশি কঠিন। কারন একটা শব্দে একাধিক যুক্তাক্ষর উচ্চারণে সমস্যা। পঞ্চতন্ত্র পড়তে সমস্যা। কিন্তু গল্প শব্দটা অনায়াসে উচ্চারণ করে। ভেবে ভেবে রবীন্দ্রনাথের গান কবিতা ধরিয়েছি। তাল ছন্দ মেলাতে যুক্তাক্ষর সমস্যা করে। ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি, বাংলার মাটি বাংলার জল, আকাশ আমার ভরলো আলোয়, অমল ধবল পালে লেগেছে, এসব জলবৎ গড় গড়িয়ে পড়ে ফেলে। তবে শব্দ গুলো এতোটাই অপরিচিত অর্থ বোঝাতে হয়। আধুনিক গান সহজে পড়ে ও বোঝে। এইতো সেদিন তুমি আমারে বোঝালে, বিধিরে এ খেয়া বাইবো কতো আর, পড়া সহজ, বোঝাও সহজ। কিন্তু মুস্কিল হলো যখনই পড়ার হোঁচট কমছে, ও বিষয়বস্তুর মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। প্রশ্ন বাড়ছে। মুস্কিল কেন সেইটা আগে বলি।
-- দিদি, ঘরের চাবি তো ভাঙে না, তালা ভাঙে। তাহলে চাবি লিখেছে কেন?
-- আমি তো লিখিনি, লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি এখন বেঁচে নেই। একথা বলিনি যে, ছন্দের কারন, তালা লিখলে তার সাথে মিলিয়ে খারাপ কথা লিখতে হতো।
একদিন হঠাৎ বলে কিনা, রবীন্দ্রনাথ ছোট বেলায় খুব দুষ্টু বান্দর ছিল। বললাম, না না, তা কেন হবে? এমন তো শুনিনি।
-- এই তো লিখেছে।
দেখি লেখা আছে " রবি করে জ্বালাতন, আছিল সবাই "। বুঝলাম, যতই বিষয়বস্তুর মধ্যে ঢুকবে এইরকম বাউন্সার গুগলি সামলাতে হবে।
-- "দিদি তোমরা যে বই পড়ো সেই বই পড়বো", একদিন সুলতা আবদার করলো। আমিও আয়তনে ছোট, কম জটিল, এমন একটা গল্প বাছলাম। রমেশচন্দ্র সেনের " মুক্তির কাঁটা "। পড়তো, পড়ার মাঝে মন্তব্য করতো। নিজেই হাসতো। অনেক সময় লাগতো। তা একদিন হলো কি, নিজের মনে সুলতা বললো "ইস্ বেচারা বংশী মুচি, মাত্র ১৫ টাকার অভাবে বিয়ে করতে পারলো না। আহারে।" আমি বলছি "কিরে কি বলিস তুই?"
-- হ্যাঁগো। এই দেখো না, বইয়ে লিখেছে।
দেখলাম, গল্পের বইয়ে লেখা আছে, "একটি মেয়েকে বংশীর পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু পণের টাকার অভাবে বংশীর সেই বিয়েটা করা হয়নি।" সেই অকার অন্ত উচ্চারণের সমস্যা।
শুধু গল্প ছড়া দিয়ে হবে না। এবার সুলতা কে সহজতম ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান বই দিতে লাগলাম। বিজ্ঞানের কিছু কিছু নিজের বয়স আর অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারে। ইতিহাস তুলনায় অনেক দুর্বোধ্য।ভূগোল খুব কঠিন লাগে, কিন্তু বিস্ময় জাগে। মানচিত্র দেখতে শিখেছে, নদী পাহাড় রেলপথ হাওড়া বর্ধমান দেখছে। অনুমান করছে বাপের বাড়ি রসুলপুর কোথায় অবস্থান। বেনারস, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, কাশ্মীর প্রতি দিন নিত্যনতুন আবিষ্কার করছে আমার কলম্বাস, সুলতা। কিন্তু আমার কলম্বাস কি যেন খুঁজে ফিরছে, পাচ্ছে না।
-- হ্যাঁরে, কি খুঁজে পাচ্ছিস না? সারাক্ষণই ম্যাপে মুখ গুঁজে আছিস দেখি।
-- ওই কেন্দ্রটা কোথায়?
-- কোন কেন্দ্র? কার কেন্দ্র?
-- নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্র।
-- মানে? নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্র? সেটা আবার কি?
-- এই দেখো, এইটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা। এইটা যোগীর ইউপি। এইটা বিহার, মন্ত্রীটার নাম ভুলে গেছি।
-- নীতিশ কমার , আমি ধরিয়ে দিই।
-- ও হ্যাঁ। এইটা দিল্লি, কেজরীওয়াল। উড়িষ্যা.... পাঞ্জাব..... আসাম.... কেরালা.... গুজরাট.... সবাই আছে। শুধু মোদির কেন্দ্র কোথাও নেই গো দিদি। অনেক খু্ঁজেও পাইনি।
-- পাবিও না। ওটা কোনো আলাদা রাজ্য না জেলা না। ওটা একটা অফিসের মতো। কিন্তু বিরাট। প্রধান মন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী, তাদের থাকার প্রাসাদ, তাদের কর্মচারী, সিপাহি সান্ত্রী এইসব হলো কেন্দ্র।
-- বুঝতে পেরেছি, একটা খুব বড়ো মতো অফিস।
সর্বোনাশ! এর আগে আমাদের কাজের মেয়ে সুমি বলেছিল ভারত পাকিস্তান হলো এক একটা ক্লাব। এরা ক্রিকেট খেলে। মাঝে মাঝে দুই দলে মারামারি হয়। ওকে দেশ বোঝাতে পারি নি সেদিন। কারন শ্রীরামপুর থেকে চন্দননগর এর বাইরে সুমি কখনও পা দেয়নি। তাও সিনেমা আর হাসপাতালের কারণে।
-- তা ওদের জমি জমা নেই, কলকারখানা নেই, তাহলে কেন্দ্রের আয় হয় কোথা থেকে? সারাক্ষণ প্লেনে চেপে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ায়, টাকা পায় কোথায়?
-- আমরা যারা চাকরি করি, আমাদের মাইনে থেকে একটা ট্যাক্স কর দিতে হয়। সারা দেশে যত ব্যবসা জমি জমা, তা থেকে একটা কর নেয়। এভাবেই সারা দেশ থেকে কেন্দ্র আয় করে।
-- সোজা কথায় রাজ্যগুলো থেকে আয় করে। আমরা যারা বাংলা বিহার আসাম এইসব রাজ্যের মানুষ, আমরা কেন্দ্রকে টাকা দিই। কেন্দ্র তাই দিয়ে ফুটানি করে। কাগজে পড়েছি গ্যাস পেট্রোলের দাম বাড়িয়ে আমাদের কাছ থেকে টাকা আয় করে।
-- দ্যাখ, এটা তো দিতেই হবে। ফুটানি হবে কেন? শুধু বাংলা বিহার এইসব রাজ্যের কথা ভাবলে চলবে?দেশটা, গোটা ভারতের কথা তো ভাবতে হবে। কর তো আমাদের দিতেই হবে।
-- তা নাহয় দিতেই হবে। তাহলে অপরের টাকায় ফুটানি একটু কম করুক। আর কথায় কথায় বলে কেন, কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে, কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে। কেন্দ্র কোথা থেকে দেবে? কেন্দ্রতো টাকা নেয়। ম্যাপেও তো কোথাও কেন্দ্র নেই। আছে রাজ্য। রাজ্য গুলোই সত্য, কেন্দ্র মিথ্যা। রাজ্যগুলোই কেন্দ্রকে টাকা দিচ্ছে। কেন্দ্র শুধু ভূতের মতো আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। যাদের ম্যাপে খুঁজে পাওয়া যায়না, দেখা যায় না। একটু এদিক ওদিক হলেই অভিশাপ, গলা টিপে ধরে। আর পূজো দিয়ে খুশি রাখলে বর দেয়, আশির্বাদ দেয়।
-- তাহলে একটু খুশি রাখতে, পূজো দিতে অসুবিধা কি ? অভিশাপ বা গলাটিপে ধরা, কোনো ভয় থাকবে না।
-- বেশ বললে দিদি। আমাদের রাজ্যের জমি জমা কারখানা, আমাদের করের টাকা নিচ্ছে। তার পরেও আরও পূজো। এবার কি হাঁড়িকাঠে মাথাটাকেও দিতে হবে? পূজো না, ভূত ভাগাতে গেলে ঝাঁটা লাগে বুঝেছো। আগের ভোটে মনে নেই? কেমন খেলা হলো।
আমি সুলতা র শিক্ষা র ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখে প্রমাদ গুনছি। একটা মানচিত্র একটু অক্ষর জ্ঞান ভাবনার সীমানা ভেঙে দিয়েছে। কল্পনায় ও বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে মুম্বাই গুজরাট দিল্লি পৌঁছে যায়। খুঁজে ফিরছে মোদিকে, কেন্দ্রকে। স্মরণ করছি গুরু বাক্য, "শিক্ষা চেতনা বাড়ায়, চেতনা বিপ্লব ঘটায়"। কি সর্ব্বোনাশ।

মালবিকার লেখার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা জানেন যে কি অনায়াস দক্ষতায় একটা সাধারণ ঘটনা থেকে পাঠকদের অন্য এক অনুভূতির জগতে পৌঁছে দিতে পারেন তিনি। সুলতানা থেকে উত্তীর্ণ সুলতাদের পড়াশোনা শেখানোর প্রচেষ্টা খুব নতুন কিছু নয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার তাল কাটতে খুব বেশি সময় লাগেনি। শেখানোর শুরুটা আমার হাতে । তবে শেখার পর কোন প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে তা বিলকুল অজানা। সেই কারণেই হয়তো আমাদের মাঝপথে রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে পড়ানো পড়ানো খেলার ময়দান ছেড়ে যেতে হয়েছে।
উত্তরমুছুনঅতি প্রাঞ্জল,সরল কিন্তু এতো সুখপাঠ্য যে সত্যিই ওনার ভাবনার প্রতি সম্মান জানাই।
উত্তরমুছুন